দেখুন কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত কি কি

কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত কি কি

কোরবানি অর্থ হলো কাছে যাওয়া বা নৈকট্য অর্জন করা, ত্যাগ স্বীকার করা বা বিসর্জন দেওয়া। পরিভাষায় কোরবানি হলো জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে শরিয়তের বিধান অনুসারে নির্দিষ্ট পশু জবাই করা। একটি কোরবানি হলো একটি ছাগল, একটি ভেড়া বা একটি দুম্বা এবং গরু, মহিষ ও উটের সাত ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ একটি গরু, মহিষ বা উট সাত শরিকে বা সাতজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা যাবে।

কোরবানির গোশত ধনী–গরিব সবাই খেতে পারেন। সুন্নাত হলো কিছু অংশ আত্মীয়স্বজনকে দেওয়া, কিছু অংশ গরিব পাড়া–প্রতিবেশীদের দেওয়া এবং কিছু অংশ নিজের পরিবারের জন্য রাখা। যত বেশি দেবে, তত ভালো। প্রয়োজনে সম্পূর্ণটাও রাখা যাবে। অনেকে সাত ভাগের এক ভাগ দিয়ে থাকেন, অনেকে সামান্য রেখে পুরোটাই দিয়ে দেন। ত্যাগের কোরবানির গোশত ভোগের জন্য পুঞ্জীভূত করে রাখা অনৈতিক ও অমানবিক। তবে বিশেষ কোনো ব্যক্তির জন্য বা শখের বশে অল্প পরিমাণে রাখলে কোনো দোষ নেই। 

আরও পড়ুনঃ ঈদুল আজহা ২০২২ কত তারিখে বাংলাদেশ । কুরবানির ঈদ ২০২২

    কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত মোট ছয়টিঃ

    কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত কি কি
    1. কুরবানী দাতা মুসলমান হওয়া, সুতরাং অমুসলিমের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
    2. কুরবানী দাতা স্বাধীন হওয়া, সুতরাং দাস-দাসীর উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
    3. কুরবানী দাতা মুকীম বা নিজ শহরের বাসিন্দা হওয়া, সুতরাং মুসাফিরের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
    4. কুরবানী দাতা নেসাবের মালিক হওয়া, সুতরাং গরীবের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। [১]
    5. বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া, সুতরাং নাবালেগের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
    6. আকেল বা বোধশক্তি সম্পন্ন হওয়া, সুতরাং নির্বোধ ও পাগলের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।

    [১] নেসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্ত্তর ক্ষেত্রে নিসাব হল এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া।

     আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্ত্ত মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।-আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫

    কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত নেসাবের মেয়াদ

    কুরবানীর নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কুরবানীর তিন দিনের মধ্যে যে কোনো দিন থাকলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২

    সাড়ে ৫২ ভরি রুপা বাজারে বিক্রয় করতে গেলে যে দাম পাড়বে তার ভিত্তিতেই নেসাব হিসাব করতে হবে। বর্তমান হিসেবে প্রতি ভরি ৪৫০ টাকা হিসেবে সাড়ে ৫২ ভরির দাম আসে ৪৫০*৫২.৫=২৩,৬২৫ টাকা। অর্থাৎ এই পরিমাণ টাকা কারো জিলহজের ১০,১১,১২ তারিখের মাঝে হাতে থাকলে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব।

    প্রত্যেকটা সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর শর্তসাপেক্ষে কুরবানী করা ওয়াজিব। আল্লাহ বলেন, ' তুমি তোমার রবের জন্য কোরবানি করো এবং সালাত আদায় করুন।' (সুরাঃ কাউসার, আয়াতঃ ২)

    আরও পড়ুনঃ লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদরের ফজিলত ২০২২

    আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি

    আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানির পশু জবাই করতে হয়। আল্লাহ তাআলার কাছে কুরবানীর পশুর মাংস বা রক্ত পৌঁছায় না, বরং তোমাদের তাকওয়া (তথা এক নিষ্ঠা ভাবে সম্পন্ন আমল) আল্লাহর কাছে পৌঁছায়।(সূরা মায়েদা, আয়াতঃ ৩৭)

    আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো বলেন, ' হে রাসুল! আপনি বলুন, আমার সালাত, আমার জীবন, আমার কোরবানি, আমার মৃত্যু বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য নিবেদিত। (সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ১৬২)

    কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত কি কি প্রশ্ন এবং উত্তর

    প্রশ্ন : গরিব ব্যক্তি কুরবানি করতে পারবে কি না?

    উত্তর : আমরা হয়তোবা অনেকি জানি যে ব্যক্তির ওপর কুরবানি ওয়াজিব নয় সেই হচ্ছে গরিব। গরিব ব্যক্তির ওপর কুরবানি ওয়াজিব নয়। হ্যাঁ, নফল কুরবানি দিতে পারে। তবে কুরবানির নিয়তে গরিব ব্যক্তি জন্তু ক্রয় করলে তা কুরবানি করা ওয়াজিব হযে যায়। এই কুরবানির গোশত সে নিজেও ভক্ষণ করতে পারবে। কিন্তু মান্নতের কুরবানি হলে গোশত খেতে পারবে না। (শামি- ৬/৩২১, বাদায়ে- ৪/১১৯)

    প্রশ্ন : কুরবানির শেষ সময়ে মুসাফির মুকিম অথবা মুকিম মুসাফির হয়ে গেলে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে কি না?

    উত্তর : এখন আমরা জেনে নিবো যে কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে শেষ সময়ের কর্তব্য। সুতরাং কেউ যদি কুরবানির সময়ের প্রথম দিকে মুসাফির থাকার পরে তয় দিন কুরবানির সময় শেষ হওয়ার পূর্বেই মুকিম হয়ে যায়, তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে। এর বিপরীতে কেউ প্রথম দিকে মুকিম থাকার পরে তয় দিনে মুসাফির হয়ে গেছে তাহলে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে না।

    উল্লেখ্য কেউ যদি কুরবানি রহিত বা না করার উদ্দেশ্যে কুরবানির শেষ সময়ে মুসাফির হয়ে যায়, তাহলে এটা অত্যন্ত প্রতারণা, ধোঁকা ও গোনাহের কাজ। তাই এ থেকে আমাদের অবশ্যই বেঁচে থাকা জরুরি। কেননা, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অন্তর্যামী। তিনি জানেন, কে কি উদ্দেশ্যে সফর করতেছে। (শামি- ৬/৩১৯, বাদায়ে- ৪/১৯৬)

    প্রশ্ন : কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে জমি ও ফসলের হিসাব করা হবে কি না?

    উত্তর : আপনার জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় জমি এবং ফসলের মূল্য বাদ দিয়ে অতিরিক্ত জমি ও ফসলের মূল্য হিসাব করা হবে। অর্থাৎ তা যদি নেসাব পরিমাণ হয় তখন কুরবানি ওয়াজিব হয়ে যাবে আপনার উপরে। (শামি-৬/৩১২, আহসানুল ফাতাওয়া-৭/৫০৬)

    প্রশ্ন : স্ত্রী বা সন্তানদের পক্ষ হতে কুরবানি করা কার ওপর জরুরি?

    উত্তর : স্ত্রী যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে। তদ্রুপ সন্তানও যদি বালেগ হয় এবং সম্পদের মালিক হয় তবে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে। এক্ষেত্রে স্বামী বা পিতার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে না।

    হ্যাঁ, তাদের নির্দেশে কিংবা অনুমতিক্রমে সে যদি কুরবানি করে দেয়, তবে আদায় হয়ে যাবে। (বাহরুর রায়েক-৮/৩১৯, আলমগির-৫/২৯২, ফাতাওয়া শামি- ৬/৩১২, মাহমুদিয়া-১৭/৩১৪)

    প্রশ্ন : যৌথ ব্যবসায় কার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে?

    উত্তর : আপনারা হয়তো অনেকি জানেন যে যৌথ ব্যবসায় প্রত্যেক অংশীদারের পৃথক মালিকানা ধর্তব্য হবে। অর্থাৎ যে যে অংশীদার পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, শুধু তাদের ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে। যদি তাদের যৌথ সম্পদ নেসাব পরিমাণ হয়, কিন্তু পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ হয় না, তবে কারো ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে না।

    মোটকথা, এক্ষেত্রে যৌথ মালিকানা ধর্তব্য নয়, পৃথক পৃথক মালিকানা ধর্তব্য। (মাজমাউল আনহুর-৪/১৬৮, আলমগিরি-৫/২৯২, বাহরুর রায়েক-৮/৩১৮, মাহমুদিয়া-১৭/৩১৩)

    প্রশ্ন : যৌথ ফ্যামিলিতে কার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে?

    উত্তর : আপনি যদি কোন যৌথ ফ্যামিলিতে বসবাস করেন তাহলে যৌথ ফ্যামিলিতে যে মূলত মালিক তার সম্পদ নেসাব পরিমাণ হয়েছে কি না এটাই ধর্তব্য। যেমন : কোনো এক ব্যক্তির দশটি সন্তান রয়েছে, পিতা এখনো সম্পদ বণ্টন করে দেন নি। তবে পিতার সম্পদ নেসাব পরিমাণ হলে কেবল তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে।

    অপরদিকে ধরুন যদি কারো পিতা বেঁচে না থাকে, শুধু ভাই-বোনেরা আছে। সবাই একান্নভুক্ত যৌথ। এখনো সম্পদ বণ্টন হয় নি। এমতাবস্থায় প্রত্যেকের পৃথক মালিকানা ধর্তব্য হবে যে, বণ্টন করলে প্রত্যেকের ভাগে কতটুকু কওে সম্পদ পড়বে। যদি প্রত্যেকের সম্পদ পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ হয়; তবে পৃথকভাবে কুরবানি ওয়াজিব হবে। মোটকথা, এখানেও পৃথক মালিকানা ধর্তব্য হবে এবং কুরবানিও পৃথকভাবে করতে হবে। (শামি-৬/৩১৫, আলমগিরি-৩/৩৪৫, মাহমুদিয়া-১৭/৩১১)

    আরও পড়ুনঃ রোজা ভঙ্গের কারণ ও রোজার মাকরুহ সমূহ

    প্রশ্ন : পশু ক্রয় করার দ্বারা কি কুরবানি ওয়াজিব হয়ে যায়?

    উত্তর : আপনারা যারা যারা ধনী ব্যক্তি রয়েছেন তাদের সকলের ওপর তো এমনিতেই কুরবানি ওয়াজিব। আর গরিব ব্যক্তি কুরবানির দিনগুলিতে কুরবানির নিয়তে পশু ক্রয় করলে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব হয়ে পড়ে। কেননা তখন তা মান্নতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। (শামি-৬/৩২১, আলমগিরি-৫/২৯১, হেদায়া- ৪/৪৪৫, মাহমুদিয়া-১৭/৩১৫)

    প্রশ্ন : অন্যের পক্ষ হতে অনুমতি ব্যতীত কুরবানি করলে তা আদায় হবে কি না?

    উত্তর : ধরুন আপনি অন্য কারো পক্ষ হয়ে তাঁর অজান্তেই কুরবানি করবেন সেক্ষেত্রে আপনাকে কিছু পন্থা অবলম্বন করতে হবে। যেমন ধরুন কারো পক্ষ হতে তার বিনা অনুমতিতে কুরবানি করলে যদি ওই ব্যক্তির ওপর কুরবানি ওয়াজিব হয়ে থাকে তবে তার কুরবানি আদায় হবে না। আর যদি ওয়াজিব না হয়ে থাকে তবে কুরবানি হয়ে যাবে। (কাজিখান-৩/৩৫২, আলমগিরি-৫/৩০২, মাহমুদিয়া-১৭/৩২২)

    প্রশ্ন : ওয়াজিব কুরবানি দ্বারা ইসালে সওয়াবের নিয়ত করা যায় কি না?

    উত্তর : নিজের ওয়াজিব কিংবা নফল কুরবানি দ্বারা জীবিত ও মৃত ব্যক্তির আমলনামায় সওয়াব পৌঁছানোর নিয়ত করা যায়। এমনকি পুরো উম্মতের ইসালে সওয়াবের নিয়ত করলেও অসুবিধে নেই। (শামি-৬/৩৩৫, আলমগিরি-৫/২৯৭, মাহমুদিয়া-১৭/৩৩০)

    প্রশ্ন : হুজুর সা. এর নামে কুরবানি করা কেমন?

    উত্তর : হুজুর সা. এর নামে কুরবানি করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। পৃথক অংশ কুরবানি করা সম্ভব না হলেও নিজের ওয়াজিব কুরবানির মাঝেই হুজুর সা. এর নামে সওয়াব পৌঁছানোর নিয়ত করলেও যথেষ্ট হবে। অন্যান্য নবীদের বিষয়টিও এমন। (আবু দাউদ শরিফ-২/৩০,শামি-৬/৩২৬)

    আমাদের পোস্ট গুলো যদি আপনার ভাল লাগে বা পড়ে উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। এছাড়াও নতুন নতুন পোস্ট পেতে আমাদের ওয়েবসাইটের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ও টুইটারে ফোলো করতে পারেন।

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

    0 মন্তব্যসমূহ